বলিউডের ‘হি-ম্যান’ আর নেই। ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু সংবাদ (Dharmendra death news) কোটি ভক্তের হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। জানুন তাঁর জীবনের ১১টি অজানা গল্প — প্রেম, সংগ্রাম, পরিবার আর সেই অদেখা মানুষটিকে, যাকে আজও বলিউড ভুলতে পারে না।
নিউজ অফবিট ডিজিটাল ডেস্কঃ মঙ্গলবার সকালের মুম্বই তখনও পুরোপুরি জাগেনি। কিন্তু লীলাবতী হাসপাতালের এক কক্ষ থেকে খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই স্তব্ধ হয়ে যায় বলিউড—প্রয়াত হয়েছেন কিংবদন্তি অভিনেতা ধর্মেন্দ্র সিং দেওল। বয়স হয়েছিল ৯০। বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন বহুদিন ধরে। শেষ পর্যন্ত, ২০২৫ সালের ১১ নভেম্বরের সকালেই থেমে গেল সেই চেনা হাসির মানুষটির নিঃশ্বাস, যাঁকে সবাই চিনত ‘হি-ম্যান অফ বলিউড’ নামে।
পাঞ্জাবের নাসরালি গ্রামের এক সাধারণ স্কুলশিক্ষকের ছেলে, ছোটবেলায় গ্রামের সিনেমা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে নায়কদের পোস্টার দেখতেন অবাক চোখে। তখন কে জানত, একদিন তাঁরই মুখে দর্শক গাইবে—“ইয়ে দোস্তি হম নেহি তোড়েঙ্গে, তোড়েঙ্গে দম মাগর লে লেঙ্গে।”
দিলীপ কুমারের মতো হতে চাওয়া সেই গ্রাম্য তরুণই একদিন নিজেই হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের প্রতীক—ধর্মেন্দ্র। জীবনের পর্দা নামলেও, রুপোলি পর্দায় তিনি অমর হয়ে রইলেন—তারই স্মৃতি তুলে ধরল এই গল্প।
জেনে নিন, ধর্মেন্দ্রর জীবনের সেই ১১টি অজানা ও অবিশ্বাস্য ঘটনা, যা আজও অনেকের অজানা।
গ্রামের ছেলে থেকে রুপোলি পর্দায়—অবিশ্বাস্য এক যাত্রা
ধর্মেন্দ্রর জীবন যেন এক সিনেমার চিত্রনাট্য। পাঞ্জাবের লুধিয়ানার নাসরালি গ্রামের সাধারণ পরিবারে জন্ম, ১৯৩৫ সালের ৮ ডিসেম্বর। বাবা কেওয়াল কিষণ সিং ছিলেন গ্রামের স্কুলের শিক্ষক, মা সত্যবন্ত কৌর ছিলেন গৃহবধূ। বাড়িতে তখনও কেউ ভাবেনি তাঁদের ছেলে একদিন ভারতীয় সিনেমার প্রতীক হয়ে উঠবে। ছোটবেলা থেকেই ধর্মেন্দ্রর টান ছিল সিনেমার পর্দার দিকে। গ্রামের সিনেমা হলে যখন ‘দেবদাস’ বা ‘আন’ চলত, বন্ধুরা লুকিয়ে নিয়ে যেত তাঁকে সিনেমা দেখতে। ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নায়কদের মতো সংলাপ বলতেন। সেই সময়ই মনে গভীরভাবে গেঁথে যায় একটাই স্বপ্ন—“একদিন আমি সিনেমায় কাজ করব।”
তবে স্বপ্নের পথ এত সহজ ছিল না। সাহনেওয়াল গ্রামে স্কুল শেষ করে তিনি ভর্তি হন ফাগওয়াড়ার রামগড়িয়া কলেজে। সেখানে একদিন এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারেন Filmfare Talent Hunt-এর কথা—“নতুন মুখের খোঁজ চলছে।” গ্রামের ছেলেটি নিজের তোলা কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে দেন মুম্বই। ভাগ্য যেন অপেক্ষায় ছিল। নির্বাচিত হন তিনি। প্রথমবার প্লেনে চেপে মুম্বই পৌঁছোন সেই তরুণ, যার চেহারায় লুকিয়ে ছিল এক যুগের উষ্ণতা। পরের কয়েক বছরেই বদলে যায় তাঁর জীবন। যে ছেলে গ্রামের মেলায় সিনেমার পোস্টার ছিঁড়ত, সে-ই হয়ে যায় সেলুলয়েডের রাজপুত্র—ধর্মেন্দ্র।
প্রথম সিনেমা ফ্লপ, কিন্তু বন্ধুত্বটা হয়ে যায় ইতিহাস
১৯৬০ সালে পরিচালক অরজুন হিংগোরানি তাঁকে সুযোগ দেন প্রথম ছবিতে—Dil Bhi Tera Hum Bhi Tere। ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, সমালোচকরাও তেমন পাত্তা দেননি, কিন্তু এই ব্যর্থতার মধ্যেই জন্ম নেয় বলিউডের এক অনন্য বন্ধুত্ব। হিংগোরানি তাঁকে বলেন, “একদিন তুমি এমন নাম করবে, তোমার নামেই সিনেমা বিক্রি হবে।” সেই কথা সত্যি হয়েছিল। পরের তিন দশকে ধর্মেন্দ্র হিংগোরানির সঙ্গে কাজ করেন Kab Kyun Aur Kahan, Khel Khiladi Ka, Kaatilon Ke Kaatil—সব সিনেমায়।
ধর্মেন্দ্র পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি বন্ধুত্বকে সাফল্যের চেয়ে বড় মানি। এই ইন্ডাস্ট্রি তোমায় ভুলে যেতে পারে, কিন্তু একজন বন্ধু থাকলে তুমি কখনও একা নও।” বলিউডের কঠিন প্রতিযোগিতার ভেতরেও তিনি ছিলেন ভীষণ মানবিক—সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন পরিবারের মতো। প্রথম ছবির ব্যর্থতা তাই তাঁর আত্মবিশ্বাস ভাঙতে পারেনি, বরং তাঁকে আরও স্থির করেছে। তিনি বলেছিলেন, “একটা ফ্লপ আমার স্বপ্ন কাড়তে পারে না।” হিংগোরানির সঙ্গে সেই বন্ধুত্বই প্রমাণ করে, ধর্মেন্দ্রর কাছে সিনেমা শুধু পেশা নয়, এটা ছিল সম্পর্ক আর আস্থার জগৎ।
সত্যকাম’—যে ছবিতে নায়ক নয়, মানুষ হয়ে উঠেছিলেন ধর্মেন্দ্র
১৯৬৯ সাল। ঋষিকেশ মুখার্জি তখন এমন একজন পরিচালক, যিনি অভিনয়ের আড়ালে মানুষের মুখ খুঁজতেন। তাঁর চোখে পড়ে ধর্মেন্দ্র। তিনি প্রস্তাব দেন Satyakam ছবির। চরিত্র—সত্যপ্রিয়, এক আদর্শবাদী ইঞ্জিনিয়ার, যিনি সত্যের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। ধর্মেন্দ্র এই চরিত্রে যা দেখিয়েছিলেন, তা শুধু অভিনয় নয়, আত্মসমর্পণ। শ্যুটিংয়ের সময় তিনি সংলাপ মুখস্থ করতেন না, বরং চরিত্রের মতো বাঁচতেন। ঋষিকেশ মুখার্জি পরে বলেছিলেন—“আমি অনেক অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি, কিন্তু ধর্মেন্দ্রর মতো চোখে সত্য দেখিনি।”
এই ছবির পর থেকেই সমালোচকেরা তাঁকে শুধু রোমান্টিক হিরো নয়, এক গভীর শিল্পী হিসেবে দেখেন। Satyakam ধর্মেন্দ্রর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছবির শেষে তাঁর চরিত্র মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু সেই দৃশ্য দেখার সময় দর্শকরা চোখ মুছেছিলেন যেন আসল মানুষটাই চলে যাচ্ছেন। Satyakam-এর সেই মুহূর্তই প্রমাণ করে, ধর্মেন্দ্র সিনেমার ভেতরে থেকেও বাস্তবকে ছুঁতে পারতেন। অনেক বছর পরে তিনি বলেছিলেন—“ওই ছবিতে আমি আমার আত্মাটাকে রেখে এসেছি।” এই ছবিই তাঁকে বানায় ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘gentle giant’।
বাস্তবের গুলিতে ভয় পেয়েছিলেন অমিতাভ — ‘শোলে’ সেটের ভয়ঙ্কর সেই দিন
‘শোলে’ শুধু ধর্মেন্দ্রর ক্যারিয়ারের নয়, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসেরই মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ছবি। কিন্তু এই ছবির শুটিংয়ের এক ঘটনার কথা খুব কম মানুষ জানেন। রমেশ সিপ্পির পরিচালনায় গব্বর-জয়-ভীরুর এই কাহিনিতে ধর্মেন্দ্র ছিলেন ভীরু চরিত্রে—রসিক, প্রাণবন্ত, অথচ সাহসী। একদিন শুটিং চলাকালে একটি অ্যাকশন দৃশ্যে ধর্মেন্দ্র এতটাই চরিত্রে ডুবে যান যে, রাগের চোটে বন্দুক থেকে সত্যিকারের গুলি ছুড়ে ফেলেন। গুলি পাশ দিয়ে উড়ে যায় অমিতাভ বচ্চনের কানের খুব কাছে। সবাই হতবাক।
অমিতাভ পরে স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, “আমি কানে ‘হুঁ’ শব্দ শুনেছিলাম—ওটা ঠিক আমার পাশ দিয়েই গেল।” ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ পরিণতিতে না গড়ালেও, সেটে সেই মুহূর্তে নেমেছিল মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা। পরে ধর্মেন্দ্র নিজে বলেন, “আমি চরিত্রে এতটা ঢুকে গিয়েছিলাম যে বাস্তব ভুলে গিয়েছিলাম।” এটা হয়তো শুনতে ছোট ব্যাপার, কিন্তু এখানেই বোঝা যায় একজন শিল্পী কতটা নিজের চরিত্রে ডুবে ছিলেন। ‘শোলে’-এর সাফল্য যেমন কিংবদন্তি, তেমনি সেই সেটের এই ভয়ঙ্কর স্মৃতিটিও আজও বলিউডের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

হেমা মালিনীর প্রতি প্রেম, বিতর্ক আর আলাদা জীবনের বাস্তবতা
বলিউডের সবচেয়ে আলোচিত প্রেমগুলির মধ্যে একটি—ধর্মেন্দ্র ও হেমা মালিনীর সম্পর্ক। তাদের প্রেম শুরু হয় ‘শোলে’-এর সময়, যখন দু’জনই ছিলেন জনপ্রিয়তার শিখরে। কিন্তু তখন ধর্মেন্দ্র বিবাহিত, তাঁর প্রথম স্ত্রী প্রকাশ কৌরের সঙ্গে চার সন্তান। হেমার পরিবার প্রথম থেকেই এই সম্পর্কের বিরোধিতা করেছিল, কারণ ধর্মেন্দ্র তখনও প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স করেননি। তবু ভালোবাসা টিকেছিল। অবশেষে ১৯৮০ সালের ২ মে, দু’জনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গোপনে বিয়ে করেন।
এই বিয়ে নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল বলিউড। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সব কিছু শান্ত হয়। আজও ধর্মেন্দ্র ও হেমা মালিনী একে অপরের জীবনে অপরিহার্য। যদিও তাঁরা একসঙ্গে থাকেন না—ধর্মেন্দ্র থাকেন প্রথম পক্ষের পরিবারের সঙ্গে, আর হেমা মালিনী থাকেন দুই কন্যা ইশা ও অহনার সঙ্গে। হেমা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “প্রতিটি মহিলা চায় একটা পূর্ণ সংসার। কিন্তু কখনও কখনও জীবন তোমার ইচ্ছেমতো হয় না।” তবুও তাঁর গলায় তিক্ততা নেই। “আমি যা পেয়েছি, সেটাই যথেষ্ট,” বলেছিলেন তিনি। এই সম্পর্কের জটিলতার মধ্যেও ধর্মেন্দ্র যে একাগ্র, দায়বদ্ধ এবং অনুভূতিপূর্ণ মানুষ ছিলেন—সেটাই হয়তো সবচেয়ে বড় সত্য।
রাজনীতি থেকে পর্দায় ফেরা — কেন সংসদ তাঁকে মানায়নি
২০০৪ সালে ধর্মেন্দ্র রাজনীতিতে পা রাখেন। রাজস্থানের বিকানের কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। ভোটে বিপুল ব্যবধানে জেতেন, কিন্তু সংসদে তাঁর মন বসেনি। কারণ খুব সহজ—তিনি রাজনীতির মঞ্চে নয়, ক্যামেরার সামনে প্রাণ পান। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি সংসদে গিয়ে সেই মানুষটাকে খুঁজে পাইনি, যে পর্দায় বাঁচে।” সংসদের শৃঙ্খলা, নীতি-নির্ধারণ, কাগজের ভাষা—সবকিছুই তাঁকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। দু’বছরের মধ্যে তাঁর সক্রিয়তা কমতে শুরু করে।
সাংবাদিকরা খোঁচা দিয়ে বলতেন, “ধর্মেন্দ্র রাজনীতিতে নিঃশব্দ।” তিনি মৃদু হেসে উত্তর দিতেন, “আমি শব্দের চেয়ে কাজকে বড় মনে করি।” শেষ পর্যন্ত তিনি রাজনীতি ছেড়ে ফেরত আসেন সেই জায়গায়, যেটা তাঁর আত্মার ঘর—সিনেমা। পর্দায় ফিরে আসেন, বয়স তখন ৭০-এর ওপরে। ‘জানি দোস্তি হম নেহি তোড়েঙ্গে’-এর ভীরুর মতোই, তিনি বলেছিলেন—“আমি সিনেমাকে ছাড়ব না, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।” ধর্মেন্দ্রর রাজনীতি হয়তো ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু শিল্পী হিসেবে তাঁর স্থিতি অমলিন হয়ে থাকে—কারণ তিনি জানতেন, তাঁর আসল সংসদ হলো দর্শকের মন।
বৃদ্ধ বয়সেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাস — ৮৭-এও পর্দায় আগুন
অনেক অভিনেতাই বয়সের সঙ্গে ক্যামেরা থেকে দূরে সরে যান, কিন্তু ধর্মেন্দ্র ছিলেন তার ব্যতিক্রম। ৮৭ বছর বয়সেও তিনি প্রমাণ করেছিলেন, আবেগ ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে বয়স কখনও বাধা নয়। করণ জোহরের Rocky Aur Rani Ki Prem Kahani ছবিতে তাঁকে দেখা গিয়েছিল ছোট কিন্তু হৃদয়গ্রাহী চরিত্রে। বয়স তখন প্রায় নব্বই। ক্লোজআপে সেই একই নরম হাসি, চোখে সেই পুরনো দীপ্তি। শুটিং সেটে তিনি মজা করে বলেছিলেন, “আমি এখনো হিরো, শুধু স্ক্রিন টাইমটা একটু কম।” এই উক্তিটিই যেন তাঁর জীবনদর্শন — কাজের বয়স হয় না। পরিচালক করণ জোহর বলেছিলেন, “তিনি ক্যামেরা অন হতেই বদলে যান, যেন আবার ৩০ বছর বয়সে ফিরে গেছেন।” ধর্মেন্দ্রর এই শেষ দিকের কাজই প্রমাণ করে, তিনি শুধু পর্দার নায়ক ছিলেন না, ছিলেন প্রেরণার এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি।
প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা এক বিনয়ী মানুষ
বলিউডের চকচকে দুনিয়ায় যেখানে প্রতিটি তারকা নিজেকে প্রচারের কেন্দ্র করে তুলতে চান, সেখানে ধর্মেন্দ্র ছিলেন এক অদ্ভুত ব্যতিক্রম। তিনি সবসময় বলেন, “আমাদের কাজই আমাদের পরিচয়।” খ্যাতির চূড়ায় থেকেও কখনও অহংকার ছুঁয়ে দেখতে দেননি নিজেকে। সাক্ষাৎকারে প্রায়ই বলতেন, “আমি আজও সেই গ্রামের মানুষ, যাকে গ্রামের লোকেরা ‘ধারাম’ বলে ডাকত।” সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি বরাবর নীরব, বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল। হেমা মালিনীর মতে, “তিনি যত বড় তারকা, ততই বড় মানুষ।” আজকের প্রচারকেন্দ্রিক বলিউডে তাঁর মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
পরিবারই ছিল তাঁর আসল গর্ব — খ্যাতি নয়, সম্পর্ক ছিল অগ্রগণ্য
ধর্মেন্দ্রর জীবন কেবল সিনেমা নয়, পরিবারও ছিল তাঁর গর্বের কেন্দ্র। প্রথম স্ত্রী প্রকাশ কৌর ও দ্বিতীয় স্ত্রী হেমা মালিনীর সঙ্গে তাঁর দুই আলাদা সংসার, তবু দু’দিকেই ছিল দায়িত্ব ও স্নেহের ভারসাম্য। তিনি কখনও সন্তানদের পেশা বেছে দিতে বাধ্য করেননি। সানি ও ববি দেওল—দু’জনকেই নিজের মতো করে বড় হতে দিয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি চাইনি আমার ছেলেরা আমার ছায়ায় ঢেকে যাক। ওদের নিজেদের আলোয় জ্বলতে দাও।” হয়তো এই কারণেই তাঁদের পরিবার আজও বলিউডের সবচেয়ে সংযত ও সম্মানীয় পরিবারের একটি। ধর্মেন্দ্রর কাছে খ্যাতি ছিল ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু পরিবার ছিল চিরস্থায়ী আশ্রয়।
হিম্যানের হৃদয়ে ছিল এক কবির বাসা — যে মানুষ হাসির আড়ালে লিখতেন একাকীত্ব
ধর্মেন্দ্রকে আমরা সবাই চিনি পর্দার হিম্যান হিসেবে — মজবুত শরীর, আত্মবিশ্বাসী হাসি, রোম্যান্টিক সংলাপ। কিন্তু খুব কম মানুষ জানে, এই শক্ত-চেহারার অভিনেতার হৃদয়ে বাস করত এক নরম, নিঃসঙ্গ কবি। শৈশব থেকেই তিনি লিখতেন উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায় কবিতা। পরে নিজের লেখা নিয়ে প্রকাশ করেন একটি বইও — Dil Ki Baatein. এতে ছিল তাঁর জীবনের একাকীত্ব, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ ও সময়ের নিষ্ঠুরতার কথা। তিনি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি কথা বলার চেয়ে লিখে নিজেকে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারি।”
বলিউডে তাঁর সহকর্মীরা জানতেন, ধর্মেন্দ্র সেটে সবার সঙ্গে হাসিখুশি থাকলেও নিজের কোণে বসে থাকতেন চুপচাপ, নোটবুকে লিখতেন কয়েকটি লাইন। তিনি একবার বলেছিলেন, “আমি আলোয় থাকি, কিন্তু ভিতরে আমি এখনো গ্রামের মানুষ—একটা নির্জনতা সবসময় সঙ্গে থাকে।” এই নরম মানবিক দিকটাই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তাঁর লেখা কবিতাগুলো আজও তাঁর ভক্তদের কাছে অমূল্য সম্পদ, কারণ সেখানে ধরা আছে এমন এক ধর্মেন্দ্র, যিনি ক্যামেরার সামনে নয়, জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সত্যিকারের অনুভব প্রকাশ করেছেন।
বিদায় নয়, উত্তরাধিকার — ধর্মেন্দ্রর জীবনের আলো আজও জ্বলছে
২০২৫ সালের ১১ নভেম্বর, মঙ্গলবার সকাল। মুম্বইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই যেন স্তব্ধ হয়ে যায় সারা দেশ। তবে তাঁর যাত্রা আসলে এখানেই থেমে যায়নি। কারণ ধর্মেন্দ্রর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার আজও জীবন্ত—সন্তানদের মধ্যে, সিনেমার পর্দায়, আর কোটি দর্শকের স্মৃতিতে। সানি দেওল থেকে ববি দেওল—দু’জনেই আজ তাঁর পথ অনুসরণ করে নিজেদের পরিচয় তৈরি করেছেন। কিন্তু তারা নিজেরাই বলেছেন, “আমাদের জন্য বাবা শুধু অভিনেতা নন, উনি আমাদের শেখিয়েছেন কিভাবে মানুষ হতে হয়।”
ধর্মেন্দ্রর জীবন এক বিরল ভারসাম্যের উদাহরণ—খ্যাতি ও নম্রতা, প্রেম ও দায়িত্ব, সিনেমা ও বাস্তবের মধ্যে তিনি কখনো সীমা টানেননি। তাই তাঁর মৃত্যু শুধু এক অভিনেতার সমাপ্তি নয়, এক যুগের অবসান। শোলে-র ভীরু যেমন বলেছিল, “ইয়ে দোস্তি হম নেহি তোড়েঙ্গে”—তেমনি ধর্মেন্দ্রর প্রতি দর্শকের ভালোবাসাও আজীবন অটুট থাকবে। তাঁর যাত্রা শেষ হলেও, তিনি থেকে গেলেন প্রতিটি দর্শকের হৃদয়ে, সিনেমার আলোয়, আর ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে—একজন মানুষ হিসেবে, যিনি শিখিয়েছিলেন, শক্তির আসল মানে মাংসপেশিতে নয়, মমতায়।
আরও পড়ুনঃ ফের আন্তর্জাতিক মঞ্চে দীপিকা

