বাংলার সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে মোয়ার ভূমিকা
জানুন Joynagarer Moa History — কনকচূড় ধান ও নলেন গুড়ের অনন্য মেলবন্ধনে তৈরি বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির গল্প। একশো বছরের ইতিহাসে কীভাবে জয়নগরের মোয়া পেল GI Tag-এর গৌরব, পড়ুন বিস্তারিত।
নিউজ অফবিট ডিজিটাল ডেস্ক: অঘ্রাণের শেষ, বাতাসে লেগেছে হিমেল পরশ। শীতকাল মানেই বাঙালির ঘরে ঘরে খেজুর গুড় আর পিঠাপুলির সুঘ্রাণ। আর এই সময়ের এক অপরিহার্য জনপ্রিয় মিষ্টি হল মোয়া। তবে সেটি নিঃসন্দেহে জয়নগরের মোয়া। এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি শুধুমাত্র জিভে নয়, মনে রাখার মতো এক সাংস্কৃতিক প্রতীক। Joynagarer Moa History নিয়ে আজকের গল্পে জানব—কীভাবে একশো বছরেরও বেশি পুরনো এই মিষ্টি পেলো জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন বা GI Tag, কীভাবে ‘কনকচূড়’ ধান ও নলেন গুড়ের জুটি গড়ে তুলল এই অনন্য স্বাদ।
জয়নগর—দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি সাধারণ শহর, কিন্তু নাম শুনলেই মিষ্টিপ্রেমীদের চোখে ঝলমল করে ওঠে। প্রায় ১৯০০ সালের দিকে স্থানীয় কৃষক ও মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারকেরা “কনকচূড়” নামের এক বিশেষ ধানের খই এবং খাঁটি নলেন গুড় মিশিয়ে তৈরি করেন এই মোয়া। জয়নগর-মজিলপুরের এক দরিদ্র মিষ্টি ব্যবসায়ী পূর্ণচন্দ্র ঘোষ এই মোয়া তৈরি শুরু করেন। প্রথমে এটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল (Joynagarer Moa History)।
পূর্ণচন্দ্র ঘোষের তৈরি এই মোয়া নরম এবং সুগন্ধযুক্ত হওয়ায় খুব অল্পদিনের মধ্যেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।এর মূল রহস্য এখানেই—কনকচূড় ধানের সূক্ষ্ম দানার সুবাস, নলেন গুড়ের ধোঁয়া ওঠা মিষ্টি ঘ্রাণ, আর গোপন অনুপাতে মেশানো গুঁড়ো নারকেল, খোয়া ক্ষীর, কিশমিশ ও কাজু। এই মিষ্টির স্বাদ এতটাই অনন্য যে, বাংলার বাইরে বিদেশেও এর কদর অগাধ। জয়নগরের মোয়া তৈরি হয় খাঁটি নলেন গুড় দিয়ে—যা পাওয়া যায় শীতকালে খেজুর গাছের রস থেকে। এই গুড়ের রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদই মোয়াকে আলাদা করে তোলে।
বর্তমানে অনেক জায়গায় কৃত্রিম গুড় ব্যবহার করে ‘নকল মোয়া’ তৈরি হয়, কিন্তু সেই মোয়া কখনই আসল জয়নগরের মোয়ার স্বাদ দিতে পারে না।
১৯০০ সাল নাগাদ জয়নগরের মোয়ার বাণিজ্যকরণ শুরু হয়। তখন বাড়ির পুরুষরা হাঁড়িতে করে হাটে, কখনও কখনও কলকাতায় গিয়ে মোয়া বিক্রি করতেন। দোকানে বিক্রি হওয়া শুরু হয় ১৯৩০ সাল নাগাদ (Joynagarer Moa History)। তারপরেও পেরিয়েছে অনেকটা সময়, জয়নগরের মোয়ার মূল বাণিজ্যকরণ শুরু হয় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে।” বর্তমানে শুধু দোকানে গিয়ে নয়, ঘরে বসেও অনলাইনে অর্ডার দিয়ে পাওয়া যেতে পারে সুস্বাদু ও খাঁটি জয়নগরের মোয়া। এই মিষ্টির আসল স্বাদ লুকিয়ে আছে ধানেই। “কনকচূড়” হলো জয়নগর অঞ্চলের স্থানীয় এক বিরল ধান, যা থেকে তৈরি হয় হালকা, ফুলে ওঠা মুরি। শীতকালে কনকচূড় ধান কাটার পরই নলেন গুড় পাওয়া যায়—এই দুইয়ের মিলনে জন্ম নেয় মোয়া।
স্থানীয়রা বলেন, ধানের ঘ্রাণ আর গুড়ের তাজা স্বাদ না থাকলে মোয়া হয় না।
২০১৫ সালের ২৩ মার্চ, জয়নগরের মোয়া পেল জিআই অর্থাৎ এর- শিরোপা। ভারতের মানচিত্রে জয়নগর আরও বেশি করে পরিচিত হলো বিখ্যাত মোয়ার জন্য। তবে মানুষের রসনা সরকারি স্বীকৃতির অনেক আগেই জয়নগরের মোয়াকে দিয়েছে ভালোবাসার স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি শুধু একটি মিষ্টির নয়, বরং একটি ঐতিহ্যের সুরক্ষা। এটি নিশ্চিত করে যে জয়নগরের বাইরে তৈরি কোনো নকল মোয়া বাজারে এসে মূল স্বাদ বা সুনাম নষ্ট করতে পারবে না। একসময় শুধু স্থানীয় হাটে বিক্রি হতো জয়নগরের মোয়া। এখন এটি কলকাতার নামী মিষ্টির দোকান, এমনকি অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও পাওয়া যায়।
তবু যারা আসল মোয়ার প্রেমিক, তারা জানেন—শুধুমাত্র জয়নগরের ঠান্ডা সকালের সেই হাতে বানানো মোয়া খাওয়ার আনন্দের বিকল্প নেই। প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোয়া সিজন চলে। এ সময় স্থানীয়রা মোয়া বানিয়ে দেশের নানা প্রান্তে পাঠান, কেউ কেউ আবার বিদেশে আত্মীয়দেরও পাঠান। জয়নগর আর বহড়ুর মোয়া নিয়ে বিতর্ক আছে। কোন জায়গার মোয়া বেশি বিখ্যাত। বহড়ু আসলে জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে। বহড়ুর শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভান্ডারের মোয়া বিখ্যাত। তবে দৈনিক বিক্রি এবং স্বাদের দিক থেকে জয়নগরের মোয়া সকলকে ছাপিয়ে যেতে পারে।
আজ জয়নগরের মোয়া শুধু একটি মিষ্টি নয়—এটি বাংলার সাংস্কৃতিক আইকন। যেমন রসগোল্লা কলকাতার গর্ব, তেমনি মোয়া হলো দক্ষিণ ২৪ পরগনার আত্মপরিচয়। জিআই ট্যাগ শুধু এই ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে তাই নয়, স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করেছে।
Most Viewed Posts
- মোটা হবেন না, মিষ্টি খান নিশ্চিন্তে │ Guilt-Free Sweets for Diwali Delight
- Dharmendra death: ধর্মেন্দ্রর জীবনের এই ১১টি তথ্য অনেকেই জানেন না │ 11 Untold Facts About Dharmendra
- Nil Sasthi 2025 : সন্তানের মঙ্গলে আজ নীলষষ্ঠী! জেনে নিন পুজোর নিয়ম, উপকরণ ও মন্ত্র
- জানেন কি নবরাত্রির চতুর্থ দিনে মা কুষ্মাণ্ডা পূজা কেন বিশেষ? ︱Why Ma Kushmanda Puja on Navratri Day 4 is Special?
- Digha Jagannath Temple Facts ︱দীঘা জগন্নাথ মন্দির সম্পর্কে জানুন এই দশটি অজানা তথ্য

