নিউজ অফবিট ডিজিটাল ডেস্ক: পৃথিবী কবে প্রথম প্রাণের জোয়ারে ভেসেছিল? এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীদের নিরন্তর প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। এতদিন ধরে চলে আসা ধারণা ছিল, পৃথিবী সৃষ্টির বেশ কিছুটা সময় পর প্রাণের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু সাম্প্রতিক এক যুগান্তকারী গবেষণা সেই ধারণাকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে। বিজ্ঞানীদের নতুন দাবি, আমাদের এই গ্রহে প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল ধারণার চেয়েও অনেক আগে। পৃথিবীর সমস্ত জীবের আদিমতম পূর্বসূরি, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘লুকা’ (LUCA) বলা হয়, তার বয়স আগের হিসাবের চেয়ে আরও অন্তত ২০ কোটি বছর পিছিয়ে গেছে।
নতুন সময়রেখা ও গবেষণার প্রেক্ষাপট:
পৃথিবীর বয়স আনুমানিক ৪৬০ কোটি বছর। এতদিন বিজ্ঞানীদের সাধারণ অনুমান ছিল, পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় ৬০ কোটি বছর পর, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে প্রথম প্রাণের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি অত্যাধুনিক গবেষণা এই সময়রেখাকে নতুন করে লিখেছে।
বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন’-এ প্রকাশিত এই গবেষণাপত্র অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৪২০ কোটি বছর আগে। অর্থাৎ, পৃথিবী সৃষ্টির মাত্র ৪০ কোটি বছরের মধ্যেই এই গ্রহ প্রাণের বসবাসের উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। এই নতুন তথ্য প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর আদিম প্রতিকূল পরিবেশেও প্রাণের উন্মেষ খুব দ্রুত ঘটেছিল।
কে এই ‘লুকা’?
‘লুকা’ বা LUCA-র পূর্ণরূপ হলো ‘লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টর’ (Last Universal Common Ancestor)। সহজ কথায়, এটি হলো পৃথিবীর সমস্ত জীবিত জীবের একক ও আদিমতম পূর্বপুরুষ। বিবর্তনের ধারায় আজকের পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে বিশাল নীল তিমি, বটগাছ কিংবা আমরা মানুষ—সবারই উৎপত্তির শিকড় গিয়ে মেশে এই একটি বিন্দুতে। লুকা কোনো নির্দিষ্ট একটি জীব নয়, বরং এটি এমন এক ধরনের আদিম এককোষী অণুজীবের প্রতিনিধিত্ব করে, যা থেকে পরবর্তীকালে প্রাণের নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে।
কেমন ছিল সেই আদিম পৃথিবী ও লুকা?
এত আদিম সময়ের কোনো জীবাশ্ম বা ফসিল পাওয়া অসম্ভব, কারণ সেই সময়ের পাথর বা শিলাস্তর পৃথিবীতে আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। তাই বিজ্ঞানীদের নির্ভর করতে হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর। গবেষকরা বর্তমানে জীবিত বিভিন্ন প্রজাতির জীবের জিনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং ‘আণুবীক্ষণিক ফাইলোজেনেটিক্স’ (Molecular Phylogenetics) নামক এক জটিল মডেল ব্যবহার করে লুকার সময়কাল ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন।
গবেষণায় উঠে এসেছে কিছু চমকপ্রদ তথ্য:
১. জটিল গঠন: লুকা কেবল একটি সাধারণ এককোষী জীব ছিল না। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি ছিল একটি প্রোক্যারিওট (Prokaryote) এবং এর গঠন ছিল বেশ জটিল।
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তথ্য হলো, এই আদিম অণুজীবের সম্ভবত নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও ছিল। সেই আদিম যুগেও ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার ক্ষমতা ছিল তাদের।
৩. আদিম বাস্তুতন্ত্র: লুকা পৃথিবীতে একা বাস করত না। বিজ্ঞানীদের অনুমান, লুকার বর্জ্য পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকত অন্য অণুজীবেরা। অর্থাৎ, ৪২০ কোটি বছর আগেই পৃথিবীতে একটি প্রাথমিক পর্যায়ের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

গবেষণার গুরুত্ব: এই গবেষণাটি জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন মনে করা হতো, ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের (আজ থেকে প্রায় ৫৩-৫৪ কোটি বছর আগে) সময়ই জীববৈচিত্র্যের আসল বিস্তার ঘটেছিল। কিন্তু নতুন এই গবেষণা বলছে, তার বহু আগেই প্রাণের ভিত্তি খুব শক্তিশালীভাবে স্থাপিত হয়েছিল।
ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের মতে, এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে জীবনের উদ্ভব একটি অত্যন্ত শক্তিশালী প্রক্রিয়া। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে খুব দ্রুত প্রাণের বিকাশ সম্ভব। এই তথ্য শুধুমাত্র পৃথিবীর প্রাণের ইতিহাস জানার জন্যই নয়, বরং ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধান করার ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে। যদি পৃথিবীর মতো গ্রহে এত দ্রুত প্রাণের সঞ্চার হতে পারে, তবে মহাবিশ্বের অন্য কোথাও একই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

